মসজিদে নববীর ভিতরে মহানবীর ﷺ ছোট একটা কামরা ছিল। কখনো-সখনো তিনি সেখানে বিশ্রাম
নিতেন। এই ঘরে আসবাবপত্র বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল একটা পানির কলস আর একটা বিছানা।
একে বিছানাই বা কিভাবে বলা যায়? এটা ছিল খেজুরের ডালের কিছু চাটাই মাত্র। একদিনের ঘটনা।




উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মহানবীর ﷺ সেই কামরায় প্রবেশ করলেন। মহানবী ﷺ শুয়ে ছিলেন। উমার (রা
) আসায় উঠে বসলেন, সালাম বিনিময় করলেন। উমার (রা) দেখলেন খেজুরের চাটাইয়ে শোয়ার কারণে
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পিঠে লাল-লাল দাগ হয়ে গেছে। রাসূলের ﷺ পিঠের এই অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে




উঠলেন উমার (রা) – “ও রাসূলাল্লাহ! দুনিয়ার বাদশা কাইসার ও কিসরা বিলাসবহুল আয়েশী জীবনযাপন
করছে, আর আপনি আল্লাহর রাসূল দোজাহানের সরদার হয়েও সামান্য খেজুরের ছালের বিছানায় শুয়ে
আছেন!” তখন মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি খারাপ ছিল? না, মোটেও না।




এই ঘটনাটি ৭ম /৮ম হিজরীর দিকে হয়েছে, যখন কিনা মুসলিমরা ইতোমধ্যেই আরব ভূখন্ডের একটা
বিশাল অংশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে — যার নেতৃত্বে আছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ । এ কারণেই,
উমার (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দুই বাদশা — রোমান বাদশা
হিরাক্লিয়াস (কাইসার) ও পারস্যের বাদশা কিসরার বিলাসী জীবনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলতে
চাইছিলেন — ওইসব বাদশাহরা যেখানে এত আরাম-আয়েশে প্রাসাদ নিয়ে থাকতে পারে
সেখানে আপনি একটু আরামদায়ক বিছানায় ঘুমালে ক্ষ’তি কি?




ভেবে দেখুন, আপনি যদি খুব ক’ষ্টদায়ক কোনো বিছানায় শুয়ে থাকেন, আর আপনার বন্ধু তখন আপনার
প্রতি স’মবেদনা জানিয়ে বলে – “আহা এই বিছানায় তোমার বড় ক’ষ্ট হচ্ছে বন্ধু!” – তাহলে আপনি এর
জবাবে কী বলবেন? আমরা হয়তো বলব – “হ্যাঁ বন্ধু, ঠিকই বলেছ। আসলেই অনেক কষ্ট হচ্ছে, এটা বদলে
ফেলা দরকার।” রাসূলুল্লাহ ﷺ কি এরকম কিছু বলেছিলেন? তিনি ﷺ কি উমার (রা)-এর এই সমবেদনা
প্রকাশে খুশী হয়েছিলেন? মোটেই না! কারণ, তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না।
তিনি ছিলেন অসাধারণ। তিনি ﷺ আল্লাহর রাসূল। তিনি লক্ষ্য রাখতেন — পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ যাতে
মাত্রাতিরিক্ত হয়ে না যায়, অতিরিক্ত আরামদায়ক বিছানা যেন তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য ওঠার ব্যাপারে
বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। উমার (রা)-এর কথায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বরং কিছুটা বিরক্তই হলেন। তিনি ﷺ বললেন –
“উমার। তুমি কি এতে খুশী নও তাদের জন্য দুনিয়া আর আমাদের জন্য আখিরাত?”




এ তো গেল মসজিদের কামরার বিছানা। মহানবীর ﷺ নিজের বাসার বিছানা কেমন ছিল? তাঁর স্ত্রী আয়িশা
(রা) বলেন – “আল্লাহর রাসূল যে বিছানায় ঘুমাতেন তা চামড়ার ছিল, এর ভেতরে খেজুর গাছের পাতা ভরা
হতো”। লক্ষ্যনীয় যে, চামড়া কিন্তু ম্যাট্রেস তৈরির উপাদান না, চামড়ার বিছানা আরামদায়কও না।
আরবরা চামড়া ব্যবহার করত উট বা ঘোড়ার জিন তৈরীতে। চামড়ার সেই শক্ত বিছানাকে
কিছুটা সহনীয় করার জন্য সাহাবীরা এর ভেতর খেজুর পাতা ভরে দিতেন।
আরেক স্ত্রী হাফসার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিছানা বলতে ছিল পাতলা এক চট।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই কষ্টদায়ক বিছানা লক্ষ্য করে হাফসা (রা) একবার এক কাজ করে বসলেন।
তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ঘুমানোর চট — যেটাকে সচরাচর দুই ভাঁজ করা হতো — সেটাকে এক রাতে
চার ভাঁজ করে দিলেন। হাফসা (রা) ভেবেছিলেন এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ঘুমের কিছুটা আরাম হবে।




অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক বিছানার কারণে সেই রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ একটু বেশী ঘুমালেন।
সকালে তিনি ﷺ যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন জিজ্ঞেস করলেন – বিছানার বিষয়টা কী? হাফসা (রা)
তখন তাঁকে ﷺ অতিরিক্ত ভাঁজের ব্যাপারটা বললেন। এতে তিনি ﷺ মোটেও খুশী হলেন না। বরং নির্দেশ
দিলেন – “একে আগের মতোই করে দিও, এটা গতকাল আমাকে তাহাজ্জুদ পড়া থেকে বিরত রেখেছে।”
এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আরামদায়ক বিছানায় না ঘুমানোর অন্যতম কারণ
ছিল বিছানার অতিরিক্ত উষ্ণতা তাঁকে ﷺ যেন তাহাজ্জুদ সালাত পড়া থেকে বিরত রাখতে না পারে।
একবার কয়েকজন সাহাবী মিলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে তাঁর ﷺ জন্য আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা
করে দিবেন বলে আর্জি পেশ করলেন। জবাবে তিনি ﷺ বললেন – “দুনিয়ার আরাম-আয়েশের কী
প্রয়োজন? আমি তো একজন পথিকের মতো, যে বিরামহীনভাবে চলতে থাকে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে




একটু আরামের জন্য গাছের ছায়ায় বসে। কিছুক্ষণ আরাম করে আবার সে চলতে থাকে।
” রেফারেন্স ও টীকা: সিরাহ সংক্রান্ত ড. ইয়াসির কাযির লেকচার – পর্ব ২ ৪৬তম
অনুচ্ছেদ, শামায়েলে তিরমিযী – মাহমুদিয়া লাইব্রেরী