বহুদিন পর বাংলাদেশ হরতাল দেখল। স্বা’ভাবিকভাবেই রাজনৈতিক প্র’তিক্রিয়াসহ বিচিত্র প্র’তিক্রিয়াও
পাওয়া গেল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, বিরল এই হ’রতাল বিপুল ধ’র্মীয় প্র’তিক্রিয়ায় আ’ক্রা’ন্ত হল। যদিও
কয়েক বছর আগে যখন ঘন ঘন হর’তাল পালিত হত, তখন দৃষ্টিগ্রাহ্য কোন ধ’র্মীয় প্র’তিক্রিয়া আম’রা
লক্ষ্য করিনি। বিগত কয়েক বছর ধ’রে একদল ‘আলিম বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ইস্যু স’স্পর্কে
মতামত জ্ঞাপন করছেন, যেমন গণতন্ত্র হা’রা’ম, হ’রতা’ল হা’রা’ম, মি’ছিল-প্র’তিবাদ হা’রাম; এগুলোতে
কোন লাভ হয় না, ফে’তনা হয়, মুসলমানদের ক’ষ্ট দেয়া হয়। তাই এসব হা’রাম। রাজনৈতিক বিষয়ে
আলিমগণের মতপ্রদান আম’রা নেতিবাচকভাবে দেখছি না। ইসলামের অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পৃক্তির নমুনা
হিসেবে আম’রা এসব মতামতকে গ্রহণ ক’রতে পারি। কিন্তু স’মস্যা অন্যখানে। ধ’র্মীয় বিষয়ের তুলনায়
রাজনৈতিক বিষয়ে মতপ্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ইস্যু বিবেচনায় নিতে হয়। এক্ষেত্রে সময়-কাল,
ফা’তওয়াপ্র’দানের স্থান তথা রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিতে হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ক্ষেত্রে যে ধ’রণের রাজনৈতিক ফাতওয়া জা’রি করবেন, হুবহু সেটি
একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রয়োগ করা যাবে না। যেমন, মি’ছিল, রাজনৈতিক স’মাবেশ, শো’ভাযাত্রা সৌদি
বা আমিরাতের মত দেশগুলোতে নি’ষি’দ্ধ। পক্ষান্তরে ওপরের ক’র্মসূচিগুলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে
কেবল সিদ্ধই নয়, বরং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এখন আম’রা যদি রাজতান্ত্রিক দেশের ফাতওয়া
গণতান্ত্রিক দেশে প্রয়োগ করি তাহলে তা কেবল কুমণ্ডুকতাই হবে না; বরং এমন একটি বার্তা দেবে যে,
জনগণের অধিকার সংকোচনে ইসলাম কর্তৃত্ববাদী সরকারের সহযাত্রী। সম্মানিত শুয়ুখ! প্রতিবাদ ও
বিদ্রোহ এক নয়। প্রতিবাদ ও খুরুজ এক নয়। গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদের প্র’কাশ ঘ’টে বিবৃতি,
মানবব’ন্ধন, মিছিল ও হর’তালের মাধ্যমে। এই অধিকার সংবিধানই জনগণকে দিয়েছে। সাংবিধানিক
অধিকার চর্চা কিছুতেই বিদ্রোহ বা খু’রুজ হতে পারে না। উপর্যুক্ত ক’র্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জা’নানো
কোনভাবেই সরকারের আনুগত্য ব’র্জন নয়, কোনভাবেই না। গণতান্ত্রিক দেশে বিদ্রো’হ বলতে বুঝায় বৈ’ধ
সরকারের বি’রুদ্ধে অ’স্ত্র’ধারণ। আনুগত্যহীনতা হল সরকারের কোন সিদ্ধা’ন্তের বিরু’দ্ধাচরণ। উদাহরণ
দিচ্ছি: কেউ যদি সরকারকে করপ্রদানে অস্বী’কার করে তাহলে সেটি হবে আনুগত্যহীনতা। কিন্তু
অতিরি’ক্ত করারোপের জন্য প্র’তিবাদ করা, মি’ছিল করা, এমনকি হ’রতাল করা কখনো আনুগত্যহীনতা
হবে না। এগুলো সংবিধানপ্রদত্ত প্রতিবাদের উপায়। আরেকটি বিষয় প্রায়শ বলা হয়। মিছিল-মিটিং-এ
কোন লাভ হয় না। এগুলোতে ফেতনা-ফাসাদ হয়। এই বক্তব্য সর্বাংশে সত্য নয়। আমি একটি বিপরীত
উদাহরণ দিই। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। সারাদেশে ব্যা’পক মিছিল ও
বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট সেটি সরিয়ে নেয়। মিছিলও যে কাজ করে, এটি তার উদাহরণ।
‘ মি’ছিল-হর’তালে মুসলিমকে কষ্ট দেয়া হয়। আর মুসলিমকে কষ্ট দেয়া হারাম। এটি একটি বহুল উচ্চারিত
যুক্তি। বেশ সুন্দরও। কিন্তু এহেন শোভনীয় যুক্তিকে বিপরীতধ’র্মী লক্ষ্যের সাথে তুলনা করে সিদ্ধা’ন্ত নিতে
হবে। যেমন, আমাদের সামনে দুটো বিবেচ্য বিষয়: একটি হল মিছিল-হরতালে জনগণের কষ্ট হয়।
আরেকটি বিষয় হল: মানুষের কিছুটা কষ্ট হলেও মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে এমন কোন বিষয় প্র’তিরো’ধ
করা সম্ভব (বা জনসচে’তনতা সৃষ্টি করা সম্ভব) যা চালু হয়ে গেলে যুগ যুগ ধ’রে মানুষ ক্ষ’তিগ্র’স্ত হবে।
এভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইস্যুগুলো পর্যালোচনা মতপ্রদানে ভারসাম্য আসবে। হ’রতালে
‘জ্বা’লাও’পোড়াও হয়, তাই হ’রতাল হা’রাম। এটিও খোঁ’ড়া যুক্তি। গণতান্ত্রিক দেশে হরতাল প্রতিবাদের
একটি আহবান। যে কেউ স্বেচ্ছায় এই আহবানে সাড়া দিতে পারে। যে কেউ স্বেচ্ছায় এই আহবানে সাড়া
নাও দিতে পারে। এই পর্যন্ত কোন স’মস্যা নেই। তবে হরতালের নামে গাড়ি ভাংচুর ও সম্পদের ক্ষ’তিসাধন
অবশ্যই হা’রাম, এতে কোন সন্দে’হ নেই। কিন্তু দু’টো ভিন্ন বিষয়। ভাংচুর ব্যতীত হরতাল হয়ে থাকে,
আম’রা দেখেছি। তাই একটি সাম’য়িক অবস্থার জন্য মূল ক’র্মসূচিকে হা’রাম বলা যায় না। হর’তালের
প্র’তিরো’ধের নামে যে নৈরা’জ্য হয়, শুধু সম্পদের ক্ষ’তি নয়, মানুষের প্রা’ণের ক্ষ’তি হয়, তাও হা’রা’ম।
কিন্তু প্রতিহরতালের ধ্বং’সাত্মক ক’র্মসূচিকে কোন শায়খ হারাম বলেছেন, এমনটা শুনিনি। বলাবাহুল্য
দু’র্বলের বি’রুদ্ধে ফা’তওয়া দেয়া যতটা সহজ সবলের বি’রুদ্ধে ফাতওয়া প্রদান ততটা ক’ঠিন। রাজনৈতিক
ও সামাজিক ইস্যুগুলোতে মতপ্রদানে বৈচিত্রময় বিবেচনা ধারণ ক’রতে হয়। আশাকরি শুয়ুখ তা
বিবেচনায় নিবেন। লেখক: ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়